ইলবার্ট বিল

  • 1873 খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি আইন অনুসারে ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার ক্ষমতা ভারতীয় বিচারপতিদের ছিলনা। একমাত্র ইউরোপীয় বিচারপতিরাই ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারতেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বিচার ব্যবস্থার এই জাতিভেদ মুলক বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে বড়লাট লর্ড রিপনের পরামর্শে তার আইন সচিব কোর্টনি পি.ইলবার্ট একটি আইনের খসড়া রচনা করেন। এই খসড়া বিলটি 9 February 1883 সালে আইনত প্রকাশিত হয়, যা ইলবার্ট বিল নামে ইতিহাসের পাতায় খ্যাত হয়ে আছে ।

ইলবার্ট বিলের মূল বিষয়বস্তু-

  • 1883 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ইলবার্ট বিলের খসড়া অনুযায়ী ভারতীয় বিচারপতিদের ইউরোপীয় বিচারপতিদের সমতুল মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় এবং বলা হয় যে ভারতীয় বিচারপতিরাও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারবেন।

ইউরোপীয়দের ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন-

  • ইলবার্ট বিলের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু করেন, যা শ্বেতাঙ্গ বিদ্রোহ বা White Mutiny নামে পরিচিত।
  • বিল প্রত্যাহারের দাবিতে ইংরেজ আইনজীবী ব্রানসন, মিলার, কেসুয়ুক প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত ‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংস্থা আন্দোলন সংঘঠিত করে।
  • ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই সংস্থার শাখা-প্রশাখা স্থাপন করে তারা ইলবার্ট বিল ও ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন। তারা এই অভিমত প্রকাশ করেন যে ইউরোপীয়দের বিচার করার যোগ্যতা ভারতীয়দের নেই।
  • সমকালীন ‘স্পেক্টেটর’ ও ‘টাইমস’ পত্রিকাও এই বিলের সমালোচনা করে।

ইলবার্ট বিলের পক্ষে ভারতীয়দের আন্দোলন-

  • এই বিলের পক্ষে ভারতীয় দের পক্ষথেকে সবচেয়ে বড়ো ভুমিকা নিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ।তার নেতৃত্বে গঠিত ‘ভারত সভা’ প্রতি আন্দোলন গড়ে তোলে। ইলবার্ট বিল এর সমর্থনে ‘ভারত সভা’ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করতে থাকে এবং সংবাদপত্রে মতামত প্রকাশ করতে থাকে।

সংশোধিত ইলবার্ট বিল-

  • ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়দের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং বিলটির কয়েকটি উদারনৈতিক ধারা এমনভাবে সংশোধন করা হয় যাতে ইলবার্ট বিলের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
  • সংশোধনী বিলে বলা হয় ভারতীয় বিচারপতিরা ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের ইউরোপীয়দের মনোনীত জুরির সাহায্য নিতে হবে।

ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব-ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্বগুলি হল-

  • ইলবার্ট বিল আন্দোলন ইউরোপীয়দের বর্ণবিদ্বেষের নগ্ন চিত্র সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয়দের ঘৃণা ভারতবাসীর চোখ খুলে দেয়। ভারতীয়রা উপলব্ধি করেন-ভারতবাসী মানেই ইংরেজদের চোখে ঘৃণার পাত্র। তাই তাঁরা নিজেদের সম্মান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেন।
  • বিলটির সংশােধনে শ্বেতাঙ্গদের জয় এই ধারণার জন্ম দেয় যে — সুসংহত , অর্থসমৃদ্ধ রাজনৈতিক সমিতির মাধ্যমেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সম্ভব ।
  • ইলবার্ট বিল বিতর্কের আগে থেকে ভারতীয় সংবাদপত্রগলি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে যে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলে আসছিল, ইলবার্ট বিল বিতর্ক সেদিকে ভারতীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
  • ইলবার্ট বিল আন্দোলনের সুফলরূপে এক বছরের মধ্যেই সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগে একটি সর্বভারতীয় জাতীয় তহবিল গঠিত হয় এবং মাদ্রাজে বীর রাঘবাচারী প্রমুখের নেতৃত্বে মহাজন সভা ও বােম্বাইয়ে ফিরােজ শাহ মেহতা প্রমুখের নেতৃত্বে বােম্বাই প্রেসিডেন্সি অ্যাসােসিয়েশন স্থাপিত হয় ।
  • ইলবার্ট বিল আন্দোলন ভারতবাসীকে স্বদেশে নিজেদের অসম্মানজনক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, যা থেকে পরবর্তীকালে চরমপন্থী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়।